September 23, 2010

বাংলাদেশে পাইরেসি : অভিশাপ না আশির্বাদ Effect of piracy in Bangladesh

আমেরিকায় মোট জাতিয় আয়ের ৪ ভাগ আসে হলিউড থেকে। এই ৪ ভাগ কি পরিমান অর্থ তা হয়ত উল্লেখ করা প্রয়োজন নেই। ধরে নিন, বিশাল পরিমান। এই আয়ের মধ্যে রয়েছে হলিউডের চলচ্চিত্র, টিভি-শো, ভিডিও গেম, মিউজিক ইত্যাদি। এককথায় এদের সবাইকেই হলিউডের প্রোডাক্ট বলা হয়। এরসাথে জড়িত রয়েছেন ...
হলিউডের কথা থাক। বাংলাদেশে টিভি নাটকের সাথে জড়িত মানুষের সংখ্যাও অনেক। প্রোডাকশন হাউজের সংখ্যাই হাজার ছাড়িয়ে। বাংলাদেশও নিশ্চয়ই পিছিয়ে নেই। কেউ হয়ত অংক কশে বলে দিতে পারবেন জাতিয় আয়ের কতভাগ আসে এখান থেকে। কত লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়।
আবার অন্য কিছু পরিসংখ্যানও রয়েছে। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। নির্মাতারা চলচ্চিত্র তৈরীতে আগ্রহী হচ্ছেন না। কেউ হয়ত গালাগালি করে বলতে পারেন, আসলে যোগ্যতা নেই। হলিউড-বলিউডের মত ভালকিছু না করলে মানুষ দেখবে কেন ? কথার কিছু যুক্তি রয়েছে। কিন্তু দোষ কি নির্মাতার ?
চলচ্চিত্র অত্যন্ত ব্যয়বহুল মাধ্যম। বহুলক্ষ টাকা ব্যয় করে একজন প্রযোজক ছবি বানালেন। তারপর তার একমাত্র ভরসা সিনেমা হল। যার অনেকগুলিই ৫০ বছর আগের প্রজেক্টর ব্যবহার করে। পরিবেশ এমনই যে সমাজের উচ্চবিত্ত তো বটেই মধ্যবিত্ত পর্যন্ত সিনেমাহলে যাওয়া মানহানিকর বিবেচনা করে। এরথেকে ঘরে বসেই দেখে নেয়া যাবে। দেখার ব্যবস্থা তো আছেই।
এ হচ্ছে চলচ্চিত্রের কথা। যা কমতে থাকে তা একসময় শেষ হয়, এই নিয়ম যদি সত্যি হয় তাহলে একসময় চলচ্চিত্র বন্ধ হতে যাচ্ছে। কাজেই একে বরং বাদ দিয়ে অন্যদের অবস্থা একবার দেখা যাক।
বাজারে নতুন অডিও সিডির অভাব নেই। যারা নিয়মিত গান শোনেন তারাও রীতিমত হিমসিম খান কার কতগুলি এলবাম বের হয়েছে তার হিসেব রাখতে। এদেরই মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছেন প্রথিতযশা শিল্পীরা। এমন না যে তারা গান-বাজনা ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের এলবাম বের হচ্ছে না। ক্লাসিকাল মিউজিক বলে কোন শব্দ নেই। এমনকি রবীন্দ্রসংগিত-নজরুলসংগিতও নেই, র‌্যাপ-হিপহপের আদলে ছাড়া। এটাও যখন কমতির দিকে তখন এর পরিনতিও চলচ্চিত্রের মতই ধরে নিতে পারেন
চলচ্চিত্রের বাইরে ভিডিওর দিকে একবার দৃষ্টি দিতে পারেন। টিভি নাটক অবশ্যই হয়। খবরের কাগজের খবর, ঈদের ৪ দিনে ৭৩ নাটক প্রচার। কাজেই নাটকের ব্যবসা রমরমা মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে কি তাই ?
একজন নাট্যশিল্পী একসাথে দুই ডজন নাটকে অভিনয় করছেন। কোন নাটকের কাহিনী কি, বক্তব্য কি, যে চরিত্রে অভিনয় করবেন তার বৈশিষ্ট কি জানার সময় নেই। ক্যামেরার সামনে দাড়ান, সংলাপ আউড়ে যান। হয়ে গেল নাটক।
তিনি সেটা করছেন কেন ? একজন শিল্পীর মুল সম্পদ তার অভিনয় প্রতিভা, সেটাকে হেলা করছেন কেন ?
করছেন কারন না করে উপায় নেই। হলিউডে একজন শিল্পীর বছরে একটা টিভিশো করাই যথেষ্ট, বাংলাদেশে তাকে করতে হয় ১ ডজন। তবে পেটেভাতে থাকা যায়।
এর পেছনের কারনই বা-কি ?
কারন নাটকের একমাত্র উপার্জন একবার টিভিতে দেখানোর সুযোগ পাওয়া (সকলেই সে সুযোগ পান না)। বিজ্ঞাপনদাতার সাহায্য নিয়ে তারা যে অর্থ দেয় তাই ভাগবাটোয়ারা হয় প্রযোজক-পরিচালক-নাট্যকার থেকে অভিনয়শিল্পী পর্যন্ত। যার নামের কাটতি বেশি তার ভাগে অর্থের পরিমান বেশি এই নিয়মে।
নাটক ছাড়াও ভিডিও হয় সেটা জানা যায় স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখলে। বিবিসি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, হিষ্টোরী চ্যানেল এদের ডকুমেন্টারী শুধু টিভিতেই দেখানো হয় না, তারপর তা বিক্রি হয় ডিভিডি-ব্লুরে প্লেয়ারে ব্যবহারের জন্য। এখানে ডকুমেন্টারী নামের কোন বস্তু নেই, কারো প্রচারনা ভিডিও ছাড়া। কারন এথেকে টাকা উপার্জন হয়না।
এর বাইরে দৃষ্টি দিতে চান ? ভিডিও গেম, সফটঅয়্যার কিংবা আরো যাকিছু করে অন্যরা ? এগুলো কখনো শুরুই হয়নি। কখনো হবে এমন কথা কেউ বলেনি।
কিছুদিন আগে একটা খবর প্রকাশ পেয়েছিল জোরেসোরে। শুধু দেশেই না, দেশের বাইরে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে। অন্তত ইন্টারনেটে তো বটেই। কোর্ট সরকারকে পাইরেসি বন্ধ করতে বলেছে এবং না করার কারন দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। ৩ মাস পরপর কোর্টে রিপোর্ট করতে বলেছে। ভিনদেশী এক ব্লগে এই খবরের ওপর মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া এক বিদেশী, বাংলাদেশে কখনো পাইরেসি বন্ধ হবে না। ওখানে আধা ডলারে উইন্ডোজ ৭ কিনতে পাওয়া যায়। রাস্তার পাশে সাজিয়ে বিক্রি করা হয়।
একথায় দেশে গৌরব বেড়েছে নাকি কমেছে সেটা বিবেচনার দায়িত্ব দেশপ্রেমিক বাঙালীর। বরং উপরে উল্লেখ করা বিষয়টিকে সংক্ষেপ করলে যা দাড়ায় সেটাই দেখা যাক,
ভিডিও গেম, সফটঅয়্যার ইত্যাদি কখনো তৈরী হবে না। চলচ্চিত্র, সংগিত এগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। নাটকের সংখ্যা বাড়ছে বন্যার পানির মত, তবে এখনই অনেকে টিভি নাটকের কথা শুনলে নাক কোচকান। কাজেই মান না বাড়লে এটাও ধ্বসে পড়বে যেকোন সময়।
অন্য দেশ কি করছে সেটা জানতে চান ?
তাদের ধারনা, মানুষের অভ্যেস পাল্টাচ্ছে। মানুষ এখন সিনেমাহলে যায় না। অবতার ২০০ কোটি ডলারের ব্যবসা করেছে এই উদাহরন না দেয়াই ভাল, অস্কার পাওয়া হার্ট লকার খুব বেশি মানুষ দেখেনি। যদিও সেটাও রীতিমত উত্তেজনাকর একশন ছবি। মানুষ ঘরে বসে ভিডিও দেখতে পছন্দ করছে। ডিভিডি-ব্লুরে, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, কিংবা ইন্টারনেট। কাজেই তারাও সেদিকেই বাজার পেতে চেষ্টা করছে। ডিভিডি কিনে ঘরে বসে দেখুন অথবা আরো কম টাকা দিয়ে ডাউনলোড করে নিন। যেকারনে এখনো তাদের পক্ষে অনায়াসে কোটি ডলার ব্যয়ে চলচ্চিত্র তৈরী সম্ভব।
তারা যদি কোটি ডলার ব্যয় করতে পারে তাহলে বাংলাদেশেও কোটি টাকা ব্যয় করা সম্ভব। তাদের সমান না হোক, অন্তত দর্শক ধরে রাখার মত চলচ্চিত্র তৈরী সম্ভব। যোগ্যতার প্রশ্ন তুলবেন না। সত্যজিত রায় কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই পথের পাচালি বানিয়েছিলেন। মৃনাল সেনও পরিচালক হয়েছিলেন কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই।
মুল প্রয়োজন অর্থ, অর্থের নিরাপত্তা। আর সেজন্য প্রয়োজন সিনেমা হল, টিভি চ্যানেলের বাইরে আয়ের সুযোগ। পাইরেসি সরাসরি সেই সুযোগ বন্ধ করে রেখেছে। এই বন্ধ দরজা না খুলে, টিভির মেগা সিরিয়ালের মত যদি খরচ কমানোই লাভের একমাত্র পথ হয় তাহলে কি হতে পারে সেটা উল্লেখ করা হয়েছে।
আপনার মনে হতে পারে অনর্থক এসব বলা হচ্ছে। হয়ত আসলেই তাই। কোর্ট কি নির্দেশ দিল তাতে সরকারের কি যায় আসে। নির্মাতাদেরই বা কি যায় আসে। পাইরেসির কত সুবিধে সেকথা ভেবে দেখেছেন। ৩০ টাকায় এক সিডি এমপিথ্রি কিনলে দুশো গান পাওয়া যায়। কিংবা সেই বিদেশীর কথার মত, উইন্ডোজ ৭ কেনা যায় আধা ডলারে। এমন আশির্বাদ আছে কোন দেশে !
পাইরেসি অভিশাপ না আশির্বাদ সেটা বিচারের দায়িত্ব আপনিই নিন।

No comments:

Post a Comment