কম্পিউটার ব্যবহার করে অনলাইনে কাজ করে অর্থ উপার্জনের সমস্যা কিছুটা হলেও জানা গেছে। অফলাইণে উপার্জনের অবস্থা কি ?
কম্পিউটার ব্যবহার করে এখানেই বহু কিছু করা সম্ভব। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে। বাস্তবে সেখানেও সমস্যার অন্ত নেই। যারা এখানেই কিছু করতে চান তাদের যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে এখানে।
গ্রাফিক ডিজাইন এবং এনিমেশন এবং ভিডিও : এই কাজের দিকে মানুষের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। প্রায় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অফিসে কিছু গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করতেই হয়। পত্রিকার বিজ্ঞাপন তৈরী অনেক কোম্পানীরই নিয়মিত কাজ। কাজ খুব বেশি হলে বেতন দিয়ে ডিজাইনার রাখেন, কেউ প্রয়োজনের সময় কারো কাছ থেকে কাজ করে নেন। পরের সংখ্যাই বেশি। ডিজাইনার হিসেবে দক্ষতা অর্জন করে আপনি এই কাজটি অনায়াসে করে দিতে পারেন। লক্ষ্য করলে দেখবেন অধিকাংশ ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। চাকরী করে লাখটাকা বেতন পাওয়া কষ্টকর, কিন্তু এভাবে লাখটাকা আয় করেন এমন ডিজাইনার/এনিমেটর রয়েছেন অনেক।
এনিমেশনের কাজ প্রায় পুরোটাই ফ্রিল্যান্সারদের দখলে। ভাল এনিমেটর চাকরী করেন না। বাংলাদেশে এনিমেশনের কাজ বলতেও একমাত্র টিভি বিজ্ঞাপনই বুঝায়। এখনও সিনেমা-টিভিতে এনিমেশন ব্যবহারের কথা কেউ ভাবেন না। এমনকি কি ভিডিও প্রেজেন্টেশনের কথাও কেউ ভাবেন না। সামর্থ্য থাকলে টিভি নয়ত খবরের কাগজ, এইই হচ্ছে প্রচারের ব্যবস্থা।
অনুষ্ঠানের ভিডিওর চাহিদা সেতুলনায় বেশি। প্রত্যেকেই চান তার বিয়ের ঘটনা ভিডিও হিসেবে হাজার বছর টিকে থাকুক। সবাই ঘরে বসে বলিউডের নায়ক-নাকিয়ার বিয়ে দেখে, তিনি বাদ থাকবেন কেন। এছাড়া জন্মদিন, অন্যান্য পারিবারিক অনুষ্ঠান, পিকনিক, অফিসের সেমিনার এসবও তো আছে। একটা ক্যামেরা আর একটা কম্পিউটার থাকলেই একাজ করা যায়।
কাজেই আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন ডিজাইনার/এনিমেটর/ভিডিও নির্মাতা হবেন। ট্রেনিং নিয়ে, পড়াশোনা করে, রাত জেগে কাজ করে এবিষয়ে দক্ষতা বাড়ালেন। তারপরই মুখোমুখি হবে সমস্যার।
বাস্তবতা ১ : কাজের জন্য কোম্পানীর দ্বারে দ্বারে ধর্না দিলেও আপনাকে কাজ দেয়া হবে না। যদি বলেন বিনে পয়সায় ট্রায়াল দেব তাহলেও না। অন্য কাজ দেখে যদি চ্যালেঞ্জ করে বলেন তারচেয়ে ভাল কাজ করে দেব তাহলেও না। তারা বোঝেন, বড় কোম্পানী মানে ভাল কাজ। ফল যা হয়, কাজ যায় নামকরা বিজ্ঞাপনী সংস্থার হাতে। তারা সেই কাজ করার জন্য আপনার সাথে যোগাযোগ করে।
এখানেও জটিলতা অনেক। তারা নিজে লাভ করতে চান। লাখ টাকার কাজ করার জন্য আপনাকে বলা হল দেয়া হবে হাজার দশেক। আপনি ভাল কাজের উদাহরন সৃষ্টি করার সংকল্প করে কাজ করলেন। তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা। আপনার হাতে এল না এক টাকাও। আপনার মনে ভয় টাকা চাইলে কাজ হাতছাড়া হয়। আরো অনেকে বসে রয়েছে কাজের আশায়। তারপরও একসময় সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় টাকা চাইতে হল। আর সত্যি সত্যিই কাজ হাতছাড়া হল। কাজদাতা নতুন আরেকজনের কাছে পাড়ি জমালেন।
কাজেই, সমস্যা নম্বর ১ : টাকা চাইলে কাজ পাবেন না, কাজ করলে টাকা পাবেন না।
বাস্তবতা ২ : টাকা ছাড়াই জনপ্রিয় কাজ করেছেন এই নাম ভাঙিয়ে হয়ত সরাসরি কাজের দেখা পেলেন। খুশিমনে কাজ করে দিলেন। কাজ দেখে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আপনিও খুশী। এই খুশি বেশিক্ষন টিকল না, কারন খুত ধরা পরেছে। তারপর সেই খুত বাড়তে শুরু করল। একসময় দেখা গেল সেটা আদৌ কোন কাজ হয়নি। নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন ঝকঝকে হতে হবে, কেউ বলেন এত রঙচঙা ভাল দেখায় না। কেউ বলেন লাল রঙ বাড়াইয়া দেন, কেউ বলেন লাল বাদ দ্যান। সকলেই বিশেষজ্ঞ, সকলেই বাংলার বাঘ। আপনি কয়েক বছর ধরে বইপত্রে যা পড়েছেন সব ভুল। সবার কথাই রাখতে হবে।
কাজেই, সমস্যা নম্বর ২ : যার কাজ করবেন তিনি বোঝেন না তিনি কি চান। যখন বুঝতে শুরু করেন তখন থামানো যায় না।
বাস্তবতা ৩ : সব কাজ যখন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তখন আপনাকে পদ্ধতি পাল্টানোর কথা ভাবতে হল। আরেকজন যে টাকায় করে তারচেয়ে কম টাকায় করে দেবেন। অল্প টাকায় যেহেতু বেশি চিনি দেয়া যায় না সেহেতু মিষ্টিও কমাতে হল। এক কাজের সময়ে তিন কাজ করতে হয়। তাহলে আর মানের কথা মাথায় রেখে লাভ কি। কদিন পর দেখলেন সমস্যা সেখানেও। আপনার পরিচিত ফুটপাতের দোকানদার একমাসের ট্রেনিং নিয়ে এসে ব্যবসা শুরু করেছে। আপনপার চেয়েও কমদামে। মান বলে যখন কথা নেই তখন কে কি করল তাতে কি যায় আসে ?
কাজেই, সমস্যা নম্বর ৩ : আপনাকে সবসময়ই মান বাদ দিয়ে দামের প্রতিযোগিতায় নামতে হবে।
বাস্তবতা ৪ : সারা বিশ্বেই বিয়ের ভিডিও জনপ্রিয় একটি বিষয়। ওয়েডিং ফটোগ্রাফি/ওয়েডিং ভিডিও নিয়ে রীতিমত বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী নেয়া যায়। আপনি তেমন কিছু করে কাজে হাত দিলেন। আপনাকে যে নিয়ম সেখানো হয়েছে সেই নিয়মেই কাজ করে দিলেন। উত্তরে যা শুনলেন তা হচ্ছে, ‘এইডা করছেন কি ? বিয়াডাই মাটি করছেন। আরেকটা বিয়া করন লাগব ভিডিওর জন্য। আরে মিয়া বিয়ার ভিডিও দ্যাখেন নাই। ওই যে বরকনে জাদুর চাদরে আকাশে উইড়া যায়, প্রজাপতির পাখনায় দেখা যায়, মাছ হইয়া সাতার কাটে। ওইসব ইফেক্ট কই ? আর শাহরুখ খানের গান কই ? দিছেন বিছমিল্লা খানের সানাই। ওই যুগ কি অহন আছে ? ওইযে সিনেমায় ঔশ্যরিয়ার বিয়ার সময় গাইল সেই গান দ্যান নাই ক্যান।’
আপনি শিখেছেন ট্রানজিশন ব্যবহার করতে হয় এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে যাবার সময়, ধরন হয় বিষয় হিসেব করে। যার ভিডিও তারকাছে এটাই দারুন ইফেক্ট। হলিউড-এডোরেজ ছাড়া বিয়ের ভিডিও হয় না। মুল ছবি দেখা যাক বা না যাক, এগুলো দেখাতে হবে। হিন্দী ছবি না দেখতে পারেন চলতি সিনেমায় যে গান আছে সেটা ব্যবহার করতে হবে। কাচি দিয়ে বরকে দুটুকরো করে ফেলবেন আর মাঝখান থেকে কণে বেরিয়ে আসবে। এই নাহলে কাজ!
কাজেই, সমস্যা নম্বর ৪ : সাইফুরস এর ভাষা পদ্ধতি, গ্রামার বইলা কিছু নাই।
বাস্তবতা ৫ : আপনি রীতিমত জেদ ধরেছেন, কোনভাবেই কোয়ালিটি স্যাক্রিফাইস করবেন না। কয়েক বছর ধরে খাওয়া-ঘুম বাদ দিয়ে যা শিখেছেন সেটা করে দেখাবেনই দেখাবেন। হলিউডের মানের এনিমেশন ব্যবহার করবেন বিজ্ঞাপনে। শুনেছেন একটা বিজ্ঞাপন তৈরীতে কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করে। আপনি নাহয় দশ লাখেই করে দেবেন। বছরে একটা কাজ করলেই চলবে।
নিজেই ট্রায়াল দিয়ে নমুনা তৈরী করলেন। কাজের প্রস্তার দিলেন। কাজ দেখে তারাও সন্তুষ্ট। তারপর উত্তর হচ্ছে, কি কইলেন ? দশ লাখ ? আমাদের বাজেট ১ কোটি। আপনে এইকাম পারবেন না।
কাজটি গেল আবারও সেই নামকরা বিজ্ঞাপনী সংস্থার হাতে। তবে এবারে আর ঘুরে আপনার কাছে এল না। একজন কাজ নিয়ে সোজা হাজির হলেন কলকাতা কিংবা দিল্লী। সফরটাও হল, বিদেশী কাজও পাওয়া গেল, বিশ/ত্রিশ লাখ নিজের একাউন্টে জমা হল। বিদেশে করা কাজ। বাপরে! সকলেই খুশি।
কাজেই সমস্যা ৫ : দেশি ঠাকুরের চেয়ে বিদেশী কুকুর দামী।
প্রশ্ন করতে পারেন এর সমাধান কি। উত্তর একটাই, সবকিছু জেনে যুদ্ধ করা। যুদ্ধে জয়ী হওয়া।
No comments:
Post a Comment